ফরিদপুরের কালো সোনা




পেঁয়াজ একটি জনপ্রিয় মসলা ও সবজি। এটি Liliaceae পরিবারের শল্ককন্দ জাতীয় ফসল যার বৈজ্ঞানিক নাম Allium cepa L. যে পেঁয়াজের ঝাঁঝ হয়ে থাকে তা হল অ্যালিল প্রপাইল ডাইসালফাইড। গাছ বড় হবার সাথে সাথে পেঁয়াজের ঝাঁঝও বাড়তে থাকে। পেঁয়াজের বীজ উত্পাদনের জন্য ফুলের শারীরতাত্ত্বিক গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পেঁয়াজের কন্দ এবং বীজ উত্পাদন একটি অপরটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো জেলায় পেঁয়াজের চাষ হয়। তারমধ্যে পাবনা, ফরিদপুর, যশোহর, রাজশাহী, বগুড়া, মানিকগঞ্জ, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, কুমিল্লা, টাংগাইল, মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদীতে প্রচুর পরিমাণ পেঁয়াজ উত্পাদন হয়। কিন্তু পেঁয়াজের বীজ উত্পাদনে ফরিদপুরের নাম সবার আগে আসে।

বাংলাদেশে সাধারণত রবি মৌসুমে পেঁয়াজের চাষ হয়। প্রায় ৩৩,২৬০ হেক্টর জমিতে মোট পেঁয়াজ উত্পাদন হয় প্রায় ১,৩১,০৯০ মে.টন। বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৫ থেকে ৬ লক্ষ মে.টন। কিন্তু পেঁয়াজ বীজের ক্ষেত্রে কৃষকদের উত্পাদিত বীজ পুরোপুরি মানসম্মত নয়। তাই ভাল বীজের জন্য অবশ্যই বীজ উত্পাদনের উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, বীজের ফলন মূলতঃ জাত, স্থান, মৌসুম ও বীজ উত্পাদন প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল।

দেশে পেঁয়াজ বীজের যে চাহিদা আছে তার ৭০ ভাগই উত্পাদন হয় ফরিদপুরে। আর এ অর্জন একদিনে হয়নি। বিভিন্নভাবে দিনের পর দিন নানামুখী সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পর আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কৃষকরা। বছরের পর বছর ধরে বেড়েই চলেছে এ অঞ্চলের পেঁয়াজ বীজের উত্পাদন। এর সাথেই পরিবর্তন ঘটেছে কৃষকের ভাগ্যের। এখন এলাকার কমবেশি সব কৃষকই পেঁয়াজের বীজ উত্পাদনের সাথে জড়িত। দীর্ঘদিন এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তাদের রয়েছে নানামুখী অভিজ্ঞতা। বৈরি জলবায়ু, মাঠের নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেও এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। আর তাদের এই এগিয়ে চলার সাথে সাথী হয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বিএডিসি’র একটি প্রকল্প। উপকরণ সহায়তা থেকে শুরু করে কৃষকদের বীজ উত্পাদনের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে ওই প্রকল্প। চলতি ২০১১-১২ বর্ষে ১৮ মে.টন পেঁয়াজ বীজ ও ৯৫ মে.টন বাল্ববীজ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পেঁয়াজ বাল্ববীজ সংরক্ষণের জন্য ফরিদপুর বিএডিসি’র নিজস্ব হিমাগার রয়েছে যেখানে উন্নত প্রযুক্তিতে ০ থেকে ২০ সে. তাপমাত্রা ও ৬৫ থেকে ৭০% আর্দ্রতায় পরবর্তী মৌসুমে উত্পাদনের জন্য পেঁয়াজ বাল্ববীজ সংরক্ষণ করা হয়।

যে সমস্ত স্থানে খুব বেশি ঠাণ্ডা বা গরম পড়ে না এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয় না, সে সব স্থানে পেঁয়াজ এবং বীজ খুব ভাল হয়। প্রচুর দিনের আলো, অনধিক উত্তাপ ও মাটিতে প্রয়োজনীয় রস থাকলে, পেঁয়াজ ও বীজের ফলন দুই-ই খুব ভাল হয়। ছোট অবস্থায় যখন পেঁয়াজের পাতা বাড়তে থাকে তখন ১৫০ সে. তাপমাত্রা ও ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা দিনের আলো থাকলে পেঁয়াজ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পরে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা দিনের আলো ও ২১০ সে. তাপমাত্রা এবং গড় আর্দ্রতা ৭০% থাকলে পেঁয়াজের কন্দ ভালভাবে বাড়ে। বীজ উত্পাদনের জন্য কিছুটা ঠাণ্ডা পরিবেশের প্রয়োজন হয়। এ অবস্থায় ৪.৫ থেকে ১৪০ সে. তাপমাত্রায় প্রতিটি কদমে অধিক সংখ্যক ফুল ও পুষ্ট বীজ হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। পুষপদণ্ড বের হওয়ার সময় ১০ থেকে ১২০ সে. তাপমাত্রার প্রয়োজন। এই তাপমাত্রা উত্পাদন মৌসুমে বিশেষ করে জানুয়ারি-ডিসেম্বর মাসে বিরাজ করে। পুসপায়ন পর্যায়ে পরিষ্কার ও উজ্জ্বল দিনের আলোয় পরাগায়নের জন্য অধিক সংখ্যক পোকা সক্রিয় থাকে। বীজ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ সময়ে উষ্ণ শুষ্ক আবহাওয়াও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাযুক্ত হালকা দো-আঁশ বা পলিযুক্ত মাটি পেঁয়াজ বীজ চাষের পক্ষে সবচেয়ে ভাল। হালকা বেলে-দো-আঁশ মাটিতে এঁটেল মাটির চেয়ে পেঁয়াজ অনেক আগে পরিপক্বতা আসে। রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে চাষ করলে পেঁয়াজ বেশ বড় ও ভারী হয় এবং সেগুলো অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। পরবর্তীতে উক্ত কন্দ থেকে উন্নত পুষ্ট, সজীব ও নিরোগ বীজ পাওয়া যায়। এঁটেল মাটি শক্ত হয়ে যায় বলে পেঁয়াজের কন্দ ভালভাবে বাড়তে পারে না ফলে পুষপদণ্ড সঠিকভাবে বাড়তে পারে না এবং ফলন কম হয়। অধিক অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব মাটিতে পেঁয়াজ আস্তে আস্তে বাড়ে, ছোট হয় এবং ফসলের পরিপক্বতা দেরিতে হয়। মাটির পিএইচ ৫.৮ থেকে ৬.৮ থাকলে পেঁয়াজের কন্দ ও বীজের ফলন ভাল হয়। পেঁয়াজ বীজ উত্পাদনের সবকিছুই বিদ্যমান বৃহত্তর ফরিদপুর জেলাতে। এ জেলার মাটি যেন পেঁয়াজ চাষিদের জন্য এক আশীর্বাদ। এ মাটিতে উত্পাদিত পেঁয়াজ বীজকে স্থানীয়রা কালো মানিক বা কালো সোনা বলে থাকেন। প্রচলিত কথা আছে যে, কয়েক কেজি পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করলে এক ভরি সোনা পাওয়া যেত। পেঁয়াজ বীজ উত্পাদনে সাফল্য ধরা দেবার পর সরকারিভাবে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। তারই অংশ হিসেবে কৃষকদের সাথে বিএডিসির চুক্তিভিত্তিক বীজ উত্পাদনের কার্যক্রম রয়েছে। কৃষকরা যাতে পেঁয়াজ বীজ উত্পাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয় সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সকল সুযোগ-সুবিধা কৃষকদের দেয়া হয় বলে জানান বিএডিসি’র জাতীয় সবজি বীজ প্রোগ্রামের পরিচালক মোঃ মাহবুবুর রহমান। তিনি আরো উল্লেখ করেন, কৃষকদের সাথে আলোচনা করেই চলতি মৌসুমের বীজের মূল্য নির্ধারণ করেছে বিএডিসি কর্তৃপক্ষ। 

গোবিন্দপুরের বখতিয়ার খান। পেঁয়াজের বীজ যাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম কৃষক। তার সফলতা এখন এই এলাকায় এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। তার জমিতে উত্পাদিত পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করে তিনি নির্মাণ করেছেন পাকা বাড়ি। তবে সফলতার এই পর্যায়ে এসে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরগুলোর কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণাও বদলে গেছে। বাজার ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকি সুবিধা বৃদ্ধি পেলে বৃহত্তর ফরিদপুরের চাষাবাদে আরো অগ্রগতি আসবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি। একই গ্রামের ক্ষুদ্র চাষি আক্কাস মণ্ডল। এবার ১ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন পেঁয়াজের বীজ। তিনি বলছেন নানা সমস্যার কথা। ভারতীয় নিম্নমানের বীজের কারণে তাদের উত্পাদিত বীজে বর্তমানে লোকসান গুনতে হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান দরকার। অম্বিকাপুরের সোহরাব হোসেনসহ আরো অনেক কৃষক বলেছেন, ভারতীয় বীজের আগ্রাসন বন্ধ করে দেশি বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলে পেঁয়াজ বীজ বিদেশে রফতানি করাও সম্ভব। বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের প্রায় সকল কৃষকের বাড়িতেই পেঁয়াজের বীজ সংরক্ষণ করা হয় পুরানো পদ্ধতিতে। উত্পাদিত বীজ রোদে শুকিয়ে বড় মাটির কলসে মধ্যে রেখে দেয়া হয়। আর এটিই বাড়ি বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যান দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতারা। পেঁয়াজের বীজ বিক্রির জন্য এ অঞ্চলে এখনো গড়ে ওঠেনি কোনো নির্দিষ্ট বাজার। একটা হিমাগার তৈরি হয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

পেঁয়াজের বীজ উত্পাদনে দারুণ সাফল্যের নজির সৃষ্টিকারী বহু কৃষকের দাবি সময় উপযোগী প্রযুক্তি সহায়তা, সরকারি প্রকল্পের সুবিধা ও বীজের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। তারা বলছেন এটি করা হলে এ অঞ্চলের কৃষকরা দেশের শতভাগ পেঁয়াজ বীজের চাহিদা পূরণ করতে সমর্থ হবেন। তাদের এই আত্মবিশ্বাসকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে এগিয়ে আসবেন এটাই তাদের প্রত্যাশা। 

Share this

Related Posts

Previous
Next Post »